সৃজনশীল প্রশ্ন, মানমণ্টন
সৃজনশীল প্রশ্ন, মানমণ্টন
সৃজনশীল প্রশ্নের ভিত্তিতে এদেশে লেখাপড়া শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে এবং জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে। শুরুতে নাম ছিল কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন। এ নামেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাঈদের প্রস্তাব অনুযায়ী নাম পরিবর্তন করে ‘সৃজনশীল প্রশ্ন’ নামকরণ করা হয়।
বৃটিশ শিক্ষাবিদ বেঞ্জামিন ব্লুম বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে মানুষের চিন্তন দক্ষতার ছয়টি স্তরের কথা বলেছিলেন। যথা : জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়ন। ব্লুমের বিভাজনে পরবর্তীতে আরেকটু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যথা : স্মরণ করা, বুঝতে পারা, প্রয়োগ করা, বিশ্লেষণ করা. মূল্যায়ন করা ও সৃষ্টি করা। বাংলাদেশে শেষের তিনটিকে উচ্চতর দক্ষতা নাম দিয়ে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের চারটি ভাগ করা হয়। এজন্য দেশব্যাপী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। বর্তমানে যে মাল্টিমিডিয়ায় ক্লাস নেওয়া হচ্ছে এবং অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে পাঠদান করা হচ্ছে তাও এই কাঠামোবদ্ধ বা সৃজনশীল প্রশ্নকে ঘিরে। আমরা প্রথমে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির আলোচনা করব, তারপর অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি ও শেষে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিয়ে আলোচনা করব।
সৃজনশীল প্রশ্ন কী?
এটি এমন এক ধরনের প্রশ্ন, যা দ্বারা শিক্ষার্থীর চিন্তন দক্ষতার সকল স্তর পরিমাপ করা যায়। এ প্রশ্নের প্রথমেই থাকে একটি উদ্দীপক। উদ্দীপকটি পাঠ্য বইয়ের এক কিংবা একাধিক বিষয়/রচনাকে ইঙ্গিত করে তৈরি করা হয়। এটি কোন দৃশ্যকল্প, চিত্র, ডায়াগ্রাম ইত্যাদি হ’তে পারে। উদ্দীপক মূলত প্রশ্ন বইয়ের কোথা থেকে করা হয়েছে এবং কী উত্তর লিখতে হবে তা স্মরণ করিয়ে দেয়। সৃজনশীল প্রশ্নে ‘ক ও খ’ প্রশ্ন পাঠ্য বই থেকে করা হয় এবং ‘গ ও ঘ’ প্রশ্ন উদ্দীপকের সাথে যুক্ত করে করা হয়। এমনভাবে করতে হয় যাতে পরীক্ষার্থী উদ্দীপকের কথা ব্যবহার না করে শুধু পাঠ্য বইয়ের ভিত্তিতে উত্তর দিতে না পারে। উদ্দীপকে বর্ণিত নতুন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী বই থেকে অর্জিত বিদ্যা ব্যবহার করে প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতার মাধ্যমে নিজের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটায়। এজন্যই সৃজনশীল প্রশ্নে উদ্দীপকের দরকার হয়। উদ্দীপকের অধীনে বাংলা গণিত ইত্যাদি বিষয় হিসাবে ৩টি থেকে ৪টি প্রশ্ন করা হয়। ৩টি হ’লে প্রথমটি অনুধাবন, দ্বিতীয়টি প্রয়োগ ও তৃতীয়টি উচ্চতর দক্ষতামূলক। আর ৪টি হ’লে প্রথমটি হবে জ্ঞানমূলক, দ্বিতীয়টি অনুধাবন, তৃতীয়টি প্রয়োগ এবং চতুর্থটি উচ্চতর দক্ষতামূলক।
জ্ঞান কী, জ্ঞানমূলক প্রশ্নের বৈশিষ্ট্য কী, এরূপ প্রশ্নের উত্তর কীরূপ?
জ্ঞা+অনট=জ্ঞান শব্দের অর্থ চেতনা বা স্মৃতিতে কোন কিছু ধারণ করা এবং প্রয়োজন মুহূর্তে তা হুবহু প্রকাশ করা। জ্ঞান বই পড়ে, চোখে দেখে, কানে শুনে এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়। অবশ্য পরীক্ষায় আগত জ্ঞানমূলক প্রশ্ন একান্তই পাঠ্য বই নির্ভর হওয়ার কথা।
জ্ঞানমূলক প্রশ্নের উত্তর একটাই। যতজন তার উত্তর করবে ততজনের একই উত্তর হবে। এটি এক শব্দে কিংবা এক বাক্যে লিখতে হয়।
এ প্রশ্নের উত্তর সঠিক হ’লে পরীক্ষার্থী এক নম্বর পাবে। কোন ভগ্নাংশ নম্বর সৃজনশীল প্রশ্নে নেই। কারণ দক্ষতার স্তরগুলোর মধ্যে কোন ভাগবাঁটোয়ারা নেই। এ প্রশ্নের উত্তরে বানান ভুল হ’লে কিংবা তথ্যগত ভুল থাকলে কোন নম্বর মিলবে না। উদ্দীপকের অধীনে দ্বিতীয় বা ‘খ’ প্রশ্ন অনুধাবনমূলক এবং তার মান ২।
অনুধাবন কী, প্রশ্নের প্রকৃতি কীরূপ, লেখার কৌশল কী এবং নম্বর কীভাবে দিতে হবে?
অনুধাবন অর্থ বুঝতে পারা। পাঠ্য বইয়ের বিষয় পড়ার মাধ্যমে নিজে কিংবা শিক্ষকের সাহায্যে সঠিকভাবে বুঝতে পারার নাম অনুধাবন। সঠিক অনুধাবন জ্ঞানকে অবলম্বন করে অর্জিত হয়। কাজেই প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট জ্ঞান না থাকলে সঠিক অনুধাবন হবে না।
অনুধাবন প্রশ্নের উত্তর বইয়ে থাকতে হবে; তবে শিক্ষার্থী নিজের ভাষায় তা লিখবে। হুবহু বইয়ের ভাষা তুলে দিলে তা হবে জ্ঞানমূলক।
এ প্রশ্নের প্রকৃতি এই যে, এর শেষে ‘কাকে বলে, ‘কেন, কীভাবে, কী বুঝ, উদাহরণ দাও, বুঝিয়ে লেখ, ব্যাখ্যা কর ইত্যাদি শব্দ থাকে। যেমন- তাওহীদে বিশ্বাস করতে হবে কেন? ব্যাকরণ শেখার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে লেখ।
অনুধাবনমূলক প্রশ্নের উত্তর সাধারণত দুই থেকে পাঁচ বাক্যের মধ্যে লিখতে হয়। কম-বেশি হ’লে দোষ নেই। তবে সঠিকভাবে অনুধাবন ফুটিয়ে তুলতে হবে। উত্তর প্যারা করেও লেখা যাবে, আবার প্যারা না করলেও অসুবিধা নেই। উত্তর সঠিক হ’লে শিক্ষার্থী ২-এ ২ পাবে। উত্তর জ্ঞান স্তরে হ’লে ১ পাবে এবং ভুল হ’লে ০ পাবে।
উদ্দীপকের অধীনে তৃতীয় বা ‘গ’ প্রশ্ন প্রয়োগমূলক এবং তার মান ৩।
প্রয়োগ কী, এ প্রশ্নের শেষে কী ধরনের শব্দ থাকে, লেখার নিয়ম কী এবং কীভাবে নম্বর দিতে হয়?
প্রয়োগ অর্থ পাঠ্য বই থেকে অর্জিত বিদ্যা নতুন ক্ষেত্রে/পরিস্থিতিতে আরোপ করা। এ ক্ষেত্রে জানা আবশ্যক যে, প্রশ্নমালায় উদ্ধৃত প্রত্যেকটি উদ্দীপক একেকটি নতুন ক্ষেত্র। তাই উদ্দীপক এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে পঠিত বিষয়ের উপর তা আলোকপাত করে এবং সে আলোয় আলোকিত হয়ে শিক্ষার্থী প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারে। বইয়ের পঠিত বিষয় উদ্দীপকে বর্ণিত নতুন ক্ষেত্রের সাথে মিলিয়ে দেওয়াই অর্জিত বিদ্যা নতুন ক্ষেত্রে ব্যবহার। উদ্দীপক শব্দের মধ্যেও আলোকপাতের অর্থ লুকিয়ে রয়েছে। উদ্দীপক = উৎ (উপসর্গ)- দীপ (ধাতু)+ণক (প্রত্যয়)। উৎ উপসর্গ উৎক্ষেপণ অর্থে এসেছে। দীপ অর্থ আলো, বাতি। ণক/অক প্রত্যয় কর্ম সম্পাদন অর্থ দিয়ে থাকে। অতএব উদ্দীপক তাই, যা কোন কিছুর উপর আলোকপাত করে। আসলেও উদ্দীপক শিক্ষার্থীর জন্য পঠিত বিষয়ের উপর আলোকের কাজ করে। যার ভিত্তিতে সে পঠিত বিষয় স্মরণ করে লিখতে পারে। তাকে মুখস্থ করতে হয় না। এখানেই মূলতঃ সৃজনশীল প্রশ্নের সার্থকতা।
প্রয়োগমূলক প্রশ্নের শেষে সাধারণত ‘ব্যাখ্যা কর’, ‘চিহ্নিত কর’, ‘মিল দেখাও’, ‘সাদৃশ্য/বৈসাদৃশ্য নির্ণয় কর’, ‘পার্থক্য নির্ণয় কর’, ‘বৈপরীত্য দেখাও’ ‘সমাধান কর’ ইত্যাদি শব্দ/বাক্যাংশ থাকে।
প্রয়োগমূলক প্রশ্নের উত্তর লেখার ক্ষেত্রে প্রথমে উদ্দীপকের ভিত্তিতে রচিত ‘গ’ প্রশ্নের বাক্যকে বিবৃতিমূলক বাক্যে রূপান্তর করে তাকে উত্তরের প্রথম বাক্য গণ্য করে লেখা শুরু করবে। বইয়ের পাঠ্যাংশের সাথে মিল করতে যে দু-একটি বাক্য না লিখলে নয় তা লিখেই পাঠ্য বইয়ের যে অংশের ভিত্তিতে উদ্দীপক রচিত সেখানে চলে যেতে হবে। তারপর উদ্দীপকের সাথে মিল রেখে বইয়ের কথা নিজের অনুধাবন অনুসারে লিখতে থাকবে। এভাবে বইয়ের কথা নিজের ভাষায় উদ্দীপকের চাহিত বিষয়ের সঙ্গে মিল করে ফুটিয়ে তোলাই সৃজনশীলতা।
সাধারণত বইয়ের বিষয়টি উত্তরে ফুটিয়ে তুলতে ৫ থেকে ৮ বাক্য এবং পুরো উত্তর ১২/১৩ বাক্যে লিখতে হয়। মনে রাখতে হবে, ‘গ’ প্রশ্নের উত্তর লিখতে অনেক পরীক্ষার্থী শুধু উদ্দীপক ইনিয়ে বিনিয়ে বড় করে লেখে কিংবা উদ্দীপক পুরো তুলে দিয়ে বইয়ের কথা দু-তিন বাক্যে লিখে উত্তর শেষ করে উদ্দীপকের সাথে পাঠ্য বিষয়ের কোন যোগ দেখায় না। কেউ বা আবার উদ্দীপকের কথা বেশী পরিমাণে লিখে বইয়ের কথা দু-এক বাক্য লিখে আবার উদ্দীপকের সাথে তার মিল দেখিয়ে উত্তর শেষ করে। উদ্দীপক নয় বরং বইয়ের তথ্য বেশী পরিমাণে প্রদান করতে হবে এবং বইয়ের তথ্য উদ্দীপকের নতুন ক্ষেত্রে ব্যবহার দেখিয়ে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পরীক্ষার্থী প্রয়োগ
সঠিক ভাবে করতে পারলে ৩-এ ৩ পাবে। উত্তর অনুধাবন স্তরে পৌঁছলে ২ পাবে, আর জ্ঞান স্তরে থাকলে ১ পাবে এবং ভুল হ’লে ০ পাবে।
উদ্দীপকের অধীনে চতুর্থ বা ‘ঘ’ প্রশ্নটি হ’ল উচ্চতর দক্ষতামূলক এবং তার মান ৪।
উচ্চতর দক্ষতা কী, প্রশ্নের শেষে কোন ধরনের শব্দ থাকে, উত্তর লেখার নিয়ম কী এবং কীভাবে নম্বর দিতে হবে?
আগেই বলা হয়েছে, উচ্চতর দক্ষতা বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়নের একত্রিত নাম। কাজেই উচ্চতর দক্ষতা বুঝতে হ’লে বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়নকে আলাদা করে বুঝতে হবে।
বিশ্লেষণঃ কোন সমগ্র বা পূর্ণকে অংশে অংশে বিভক্ত করে দেখানোকে বিশ্লেষণ বলে। যেমন- ‘একটি ফুল বিশ্লেষণ কর’-প্রশ্ন করা হ’লে যদি শিক্ষার্থী ফুলের পাঁচটি অংশ যথা- বৃন্ত, বৃতি, পাঁপড়ি, পুংকেশর ও স্ত্রীকেশর উদ্ধৃত করতে পারে তাহ’লে বিশ্লেষণের উত্তর হবে।
ধন্যবাদ।
দিগন্ত কুমার রায়
Comments
Post a Comment